বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে আমরা এক অস্থির ও লক্ষ্যহীন প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তুলছি। এই প্রজন্মের অধিকাংশেরই কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ বা জীবন লক্ষ্য নেই। তারা নিজেদের মধ্যে কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত আদর্শিক মূল্যবোধ এবং মহান উদ্দেশ্যের অভাব বোধ করছে। পবিত্র কুরআন ও নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা কীভাবে আমাদের প্রজন্মকে এই সমস্যাগুলো থেকে বের করতে পারি, সেই আলোচনা করা প্রয়োজন।
১. ইসলামের শিক্ষা ও জীবনের লক্ষ্য
আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি জিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি কেবল এজন্য যে, তারা আমার ইবাদত করবে” (সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬)। জীবনের মূল লক্ষ্যই আল্লাহর ইবাদত এবং তার সন্তুষ্টি অর্জন। কিন্তু আমাদের বর্তমান প্রজন্ম আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদতের পরিবর্তে নিজেদের ইচ্ছা ও চাহিদার পেছনে ছুটছে। ইসলামের মূল শিক্ষা অনুযায়ী জীবন যাপন করা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা তাদের জীবনের লক্ষ্য হতে পারে, যা তাদেরকে স্থিরতা ও সত্যিকারের শান্তি দান করবে।
২. জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব
কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তুমি বল, হে আমার প্রভু, আমাকে জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও” (সূরা ত্বাহা: ১১৪)। জ্ঞানার্জন ইসলামের মূল ভিত্তিগুলোর একটি। কিন্তু আমাদের বর্তমান প্রজন্ম বই পড়া, নিউজপেপার পড়া, কিংবা জ্ঞান চর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ইসলামি শিক্ষার প্রতি অনীহা দূর করতে, তাদেরকে জ্ঞানার্জনের পথ দেখানো উচিত। সীরাত, ইসলামের ইতিহাস, সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থগুলো তাদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে এবং তাদের মনে আদর্শিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে পারে।
৩. শিষ্টাচার ও বিনয়
আমাদের প্রিয় নবীজী (সা.) বিনয়ী ও শিষ্টাচারপূর্ণ আচরণের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র উত্তম” (সহীহ আল-বুখারী: ৩২৯৫)। বর্তমানে দেখা যায়, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিনয়ের অভাব। বড়দের সম্মান করা, ধৈর্যশীল হওয়া, কৃতজ্ঞতাবোধ, বিনয় ও শ্রদ্ধাবোধের চর্চা তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবীজীর জীবনের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তাদের মধ্যে এসব গুণাবলী বিকাশে উৎসাহিত করতে হবে।
৪. স্বাস্থ্য ও শারীরিক শক্তি অর্জন
নবীজী (সা.) বলেন, “শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিনের চেয়ে উত্তম ও অধিক প্রিয়” (মুসলিম: ২৬৬৪)। অথচ আমাদের তরুণরা শারীরিক কার্যকলাপ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। রৌদ্রে হাঁটা, বৃষ্টিতে ভেজা, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা, খেলাধুলা করা – এসব কার্যক্রম তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। ইসলামিক শিক্ষার আলোকে তাদেরকে স্বাস্থ্যসচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করা উচিত।
৫. ত্যাগের মানসিকতা ও বিনয়ী চরিত্র
ইসলামে ত্যাগের বড় মর্যাদা রয়েছে। সাহাবী হযরত আবু বকর (রা.) আল্লাহর পথে তার সকল সম্পদ ত্যাগ করেছিলেন। বর্তমান প্রজন্মকে বিনয়ের সাথে চলতে, বড়দের সম্মান করতে এবং তাদের প্রতি সহমর্মী হতে শেখানো প্রয়োজন। তাদের মনে এই ত্যাগ ও সহমর্মিতার গুণাবলী গড়ে তুলতে হবে।
৬. সময়ের মূল্যায়ন ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা
আমাদের নবীজী (সা.) বলেন, “দুটি নিয়ামত আছে, যার ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়: স্বাস্থ্য ও অবসর সময়” (সহীহ আল-বুখারী: ৬৪১২)। তরুণদের মধ্যে অবসর সময়ের যথাযথ ব্যবহার নেই, তারা অনলাইনে সারারাত কাটিয়ে সারা সকাল ঘুমায়। ইসলাম সময়ের মূল্য বুঝতে এবং পরিকল্পিত জীবনযাপনে উৎসাহ দেয়। তাদের উচিত সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগানো এবং ইবাদত, পড়াশোনা ও শারীরিক কার্যকলাপে সময় ব্যয় করা।
৭. প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার
ইসলাম প্রযুক্তি ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করেনি, বরং এর সঠিক ও প্রয়োজনীয় ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রযুক্তিকে জ্ঞানার্জন, দক্ষতা উন্নয়ন এবং দাওয়াতি কাজের জন্য ব্যবহার করা উচিত। তরুণদের মধ্যে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
বর্তমান প্রজন্মকে ইসলামের আলোকে সঠিক পথে পরিচালিত করা এবং তাদের মধ্যে আদর্শিক গুণাবলী সৃষ্টি করা আমাদের দায়িত্ব। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য জীবন পরিচালনা করা, বিনয়, শ্রদ্ধাবোধ ও শারীরিক সুস্থতা অর্জন করার মাধ্যমে তারা হয়ে উঠতে পারে ইসলামের সত্যিকার অনুসারী। আল্লাহ আমাদের এই প্রজন্মকে ইসলামের ছায়াতলে ফিরিয়ে আনুন এবং তাদের জন্য সহজ করে দিন। আমীন।