সূরা আনফাল (৮:২৪) একটি অত্যন্ত গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ আয়াত, যা মুমিনদের আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য এবং জীবনের প্রকৃত অর্থ নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করে। এই আয়াত মানুষের আধ্যাত্মিক জাগরণ, আল্লাহর ক্ষমতার প্রতি স্মরণ এবং পরকালীন জীবনের জন্য প্রস্তুতি সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। এই আর্টিকেলে আমরা আয়াতটির প্রতিটি অংশের ব্যাখ্যা এবং এর অন্তর্নিহিত শিক্ষার বিশদ বিশ্লেষণ করব।
আয়াত ও এর অর্থ:
আরবি পাঠ:
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱسْتَجِيبُوا۟ لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمۡ لِمَا يُحۡيِيكُمۡۖ وَٱعۡلَمُوٓا۟ أَنَّ ٱللَّهَ يَحُولُ بَيۡنَ ٱلۡمَرۡءِ وَقَلۡبِهِۦ وَأَنَّهُۥٓ إِلَيۡهِ تُحۡشَرُونَ
উচ্চারণ:
ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানু, স্তাজিবু লিল্লাহি ওয়া লির রসুলি ইজা দা’আকুম লিমা ইউহইকুম। ওয়া’লামু আন্নাল্লাহা ইয়াহুলু বাইনাল মারি ওয়া কালবিহি ওয়া আন্নাহু ইলাইহি তুহশারুন।
বাংলা অর্থ:
“হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও, যখন তারা তোমাদের এমন বিষয়ে আহ্বান করেন, যা তোমাদের জীবন দান করে। আর জেনে রাখো, আল্লাহ মানুষ ও তার অন্তরের মধ্যবর্তী হতে পারেন এবং তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।”
আয়াতের প্রধান দিকগুলো:
১. “হে মুমিনগণ!”—বিশেষ সম্বোধন:
- এই আয়াতটি সরাসরি মুমিনদের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছে।
- মুমিন কারা?
মুমিন তারা, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে এবং ইসলামের বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে। কুরআনে বলা হয়েছে:
“মুমিন তারাই, যারা ঈমান আনে এবং এরপর আর কোনো সন্দেহ পোষণ করে না।”
(সূরা হুজুরাত: ১৫)
২. “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও”:
- আল্লাহ এবং রাসূলের ডাকে সাড়া দেওয়ার অর্থ হলো তাদের আদেশ মেনে চলা।
- কিভাবে এই ডাক আসে?
১. কুরআনের মাধ্যমে:
কুরআনই আল্লাহর প্রধান আহ্বান, যা মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক।
২. রাসূলের সুন্নাহ:
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন এবং তাঁর হাদিস মানবজাতির জন্য আল্লাহর দিকনির্দেশনা বহন করে।
৩. মুসলিম সমাজের দাওয়াত:
ইসলামের শিক্ষা প্রচার এবং সঠিক পথে চলার আহ্বানও আল্লাহ ও রাসূলের আহ্বানের একটি অংশ।
৩. “যা তোমাদের জীবন দান করে”:
- জীবন দান করার অর্থ কী?
এখানে “জীবন দান করা” বলতে আধ্যাত্মিক, নৈতিক, এবং পার্থিব জীবনে সজীবতা আনা বোঝানো হয়েছে।
১. আধ্যাত্মিক জীবন:
ইসলামের দাওয়াত মানুষের অন্তরকে জীবিত করে এবং ঈমানের আলো জ্বালায়।
“আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন, তার হৃদয়কে ইসলামের জন্য প্রশস্ত করেন।”
(সূরা আন’আম: ১২৫)
২. পার্থিব জীবন:
ইসলামের নীতিমালা অনুসরণ করলে সমাজে শান্তি, ন্যায়বিচার, এবং সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. পরকালীন জীবন:
আল্লাহর নির্দেশ মেনে চললে মানুষ জান্নাতের চিরস্থায়ী জীবনের অধিকারী হবে।
৪. “আল্লাহ মানুষ ও তার অন্তরের মধ্যবর্তী হতে পারেন”:
- এই বাক্যে আল্লাহর ক্ষমতা এবং তাঁর সর্বজ্ঞানী হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট।
- অন্তরের ওপর আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ:
মানুষের চিন্তা, ইচ্ছা, এবং সিদ্ধান্ত সরাসরি আল্লাহর ইচ্ছার অধীন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“মানুষের অন্তর আল্লাহর আঙুলসমূহের মধ্যে থাকে। তিনি যেভাবে চান, সেভাবে তা পরিবর্তন করেন।”
(সহিহ মুসলিম: ২৬৫৪) - মানুষের সীমাবদ্ধতা:
এই আয়াত মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তার অন্তর এবং তার ইচ্ছার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কেবল আল্লাহর হাতে।
৫. “তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে”:
- এই অংশটি মানুষের চূড়ান্ত গন্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
১. মৃত্যুর পর প্রত্যাবর্তন:
প্রত্যেককে মৃত্যুর পর আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে।
“প্রত্যেক আত্মাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এবং তোমরা তোমাদের কর্মফলের পূর্ণ প্রতিদান পাবে।”
(সূরা আলে ইমরান: ১৮৫)
২. চূড়ান্ত বিচার:
কিয়ামতের দিন মানুষ তার কাজের জন্য পুরস্কৃত বা শাস্তিপ্রাপ্ত হবে।
“যে ব্যক্তি এক কণার পরিমাণ সৎ কাজ করেছে, সে তা দেখতে পাবে।”
(সূরা যিলযাল: ৭)

আয়াত থেকে শিক্ষা:
১. আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ মেনে চলার গুরুত্ব:
- মুমিনদের উচিত আল্লাহ এবং রাসূলের প্রতিটি নির্দেশনা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করা।
- এটি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতিই নয়, বরং দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিত করে।
২. আত্মিক ও পার্থিব জীবনে সজাগ থাকা:
- ইসলামের বিধান মেনে চলা মানুষের জীবনে শান্তি ও স্থিতি আনে।
- আল্লাহর আদেশে অবহেলা করলে আধ্যাত্মিকভাবে জীবনের সজীবতা হারিয়ে যায়।
৩. আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভরতা:
- আমাদের চিন্তা, ইচ্ছা, এবং হৃদয়ের উপর আল্লাহর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তাই আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমরা কোনো ভালো কাজ করতে পারি না।
৪. পরকালীন জীবনের জন্য প্রস্তুতি:
- মানুষের কর্মফল পরকালে নির্ধারিত হবে। এই আয়াত আমাদের জীবনের প্রতিটি কাজকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য উৎসর্গ করতে উৎসাহিত করে।
উপসংহার:
সূরা আনফাল, আয়াত ২৪, মুমিনদের জন্য একটি গভীর শিক্ষা বহন করে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আল্লাহ এবং রাসূলের নির্দেশ মেনে চলা আমাদের জীবনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। “জীবন দান করা” বলতে বোঝানো হয়েছে আধ্যাত্মিক, পার্থিব, এবং পরকালীন জীবনের সাফল্য।
এটি আমাদের অন্তর এবং আমলের উপর আল্লাহর ক্ষমতা এবং কিয়ামতের দিন জবাবদিহিতার ব্যাপারে সতর্ক করে। তাই আমাদের উচিত আল্লাহ এবং রাসূলের প্রতিটি নির্দেশ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করা এবং সঠিক পথে চলার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকা।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই আয়াতের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।