আয়াত:
“পরম পবিত্র তিনি, যিনি রাত্রি বেলায় তাঁর বান্দাকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছেন, যার চারপাশ আমি বরকতময় করেছি, যাতে আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।”
(সূরা আল-ইসরা: ১)
এই আয়াতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিখ্যাত ইসরা ও মেরাজ এর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এটি ইসলামের ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা এবং ঈমানদারদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নিদর্শন।
১. ইসরা (মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত রাত্রি বেলায় ভ্রমণ)
এই আয়াত ইসরার দলিল:
- এই আয়াতেই আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর রাতের সফরের দলিল দিয়েছেন। এখানে উল্লেখিত ভ্রমণ হলো ইসরা, যা নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা পর্যন্ত রাত্রি বেলায় করানো হয়েছিল।
- এই ভ্রমণ অত্যন্ত দ্রুত সম্পন্ন হয়েছিল, যা আল্লাহর অসীম ক্ষমতার নিদর্শন।
আরো দলিল:
ইসরা ও মেরাজের ঘটনা কুরআনের পাশাপাশি হাদিসে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
- সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমের হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:
“এক রাতে আমি মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যাওয়া হই। সেখানে আমি নবীদের সাথে নামাজ পড়ি এবং সেখান থেকে আমাকে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়।”
(সহিহ বুখারি: ৩২০৭, সহিহ মুসলিম: ১৬২)
ভ্রমণের সময়:
ইসরা ও মেরাজের ঘটনা নবুওয়াতের দশম বা একাদশ বছরে ঘটেছিল। এটি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর মানসিক এবং আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য ঘটানো হয়, বিশেষত তায়েফে অবর্ণনীয় কষ্ট পাওয়ার পর।
২. “যার চারপাশ আমি বরকতময় করেছি”
কিসের চারপাশ এবং কোথায়:
- এই অংশে আল্লাহ মসজিদুল আকসা এবং এর চারপাশের ভূখণ্ডকে বরকতময় বলে উল্লেখ করেছেন।
- মসজিদুল আকসার অবস্থান:
এটি ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে অবস্থিত। এটি ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। - চারপাশ:
- জেরুজালেম এবং এর আশপাশের অঞ্চল, যা “শাম” (সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন, ফিলিস্তিন) নামে পরিচিত।
- এটি ঐতিহাসিকভাবে নবীদের ভূমি এবং বহু নবীর জন্মস্থান।

কিভাবে বরকতময় করা হয়েছে?
- আধ্যাত্মিক বরকত:
- এই ভূমি বহু নবী যেমন ইব্রাহিম (আঃ), দাউদ (আঃ), সোলায়মান (আঃ), ঈসা (আঃ)-এর কর্মস্থল।
- এখানে আল্লাহর বাণী নাযিল হয়েছে এবং নবীদের শিক্ষা প্রচারিত হয়েছে।
- প্রাকৃতিক বরকত:
- এই ভূমি ফল, শস্য, এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ।
- ধর্মীয় গুরুত্ব:
- মসজিদুল আকসা ছিল কিবলা (প্রথম দিকের মুসলিমদের নামাজের দিক)।
৩. “যাতে আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাই”
কোন নিদর্শনের কথা বলা হয়েছে?
- আল্লাহ তাআলা নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে তাঁর অসীম কুদরতের বিভিন্ন নিদর্শন দেখিয়েছেন।
- এটি দুটি ধাপে ঘটে:
- ইসরা: মক্কা থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত।
- মেরাজ: আসমানের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত।
রাসুল (সাঃ)-কে কি কি দেখানো হয়েছে?
- সিদরাতুল মুনতাহা:
- এটি সপ্তম আসমানের শেষ সীমা।
- রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সেখানে জিবরাইল (আঃ)-এর আসল রূপ দেখেন।
- আল্লাহ বলেন:
“তিনি তাঁকে দ্বিতীয়বার দেখেছেন সিদরাতুল মুনতাহার কাছে।”
(সূরা আন-নাজম: ১৩-১৪)
- জান্নাত ও জাহান্নামের দৃশ্য:
রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে জান্নাতের শান্তি এবং জাহান্নামের শাস্তি দেখানো হয়। - পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের নির্দেশ:
- মেরাজের সময় নবী (সাঃ) আল্লাহর কাছ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিধান পান।
- এটি মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে বড় ফজিলতের বিষয়।
- নবীদের সাথে সাক্ষাৎ:
- রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আসমানের বিভিন্ন স্তরে আদম (আঃ), ইবরাহিম (আঃ), মূসা (আঃ), ঈসা (আঃ)-এর মতো নবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
৪. প্রাসঙ্গিক তথ্য
ইসরা ও মেরাজের শিক্ষাগুলো:
- আল্লাহর কুদরত ও শক্তি:
এই ঘটনা মানুষের মধ্যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আরও দৃঢ় করে। - ধৈর্যের শিক্ষা:
মেরাজের ঘটনা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবনের কষ্টকর সময়ে তাঁর আত্মবিশ্বাস এবং ধৈর্য বৃদ্ধি করে। - ইবাদতের গুরুত্ব:
মেরাজের অন্যতম ফল হলো সালাতের বিধান, যা মুসলমানদের ইবাদতের মূল স্তম্ভ।
ইসরা ও মেরাজের ঘটনা কুরআন ও হাদিসে প্রমাণিত:
- কুরআনে (সূরা আল-ইসরা: ১, সূরা আন-নাজম: ১৩-১৮) সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে।
- হাদিসের বিস্তারিত বিবরণ সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমসহ বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখিত।
মুসলমানদের দায়িত্ব:
- ইসরা ও মেরাজের শিক্ষা গ্রহণ করা এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল হওয়া।
- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাযথভাবে আদায় করা।
উপসংহার
সূরা আল-ইসরা, আয়াত ১, ইসরা ও মেরাজের অসাধারণ ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে। এটি আল্লাহর কুদরত এবং নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মর্যাদার নিদর্শন। এই আয়াত মুসলমানদের আল্লাহর প্রতি ঈমান, ইবাদত, এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতি উৎসাহিত করে। আমাদের উচিত এই ঘটনার শিক্ষা নিয়ে জীবন পরিচালনা করা এবং আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য প্রদর্শন করা। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমিন।