বিশ্বের অন্যতম লাভজনক এবং বিতর্কিত শিল্প হলো পর্ন ইন্ডাস্ট্রি। এই শিল্পটি বছরের পর বছর ধরে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হলেও এর সামাজিক, নৈতিক এবং মানসিক প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে বিতর্ক রয়েছে। একদিকে এটি একটি বিশাল অর্থনৈতিক অবদান রেখে চলেছে, অন্যদিকে এটি নৈতিক অবক্ষয়, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং নারী অধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয়গুলোকে ঘনীভূত করছে।
পর্ন ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান অবস্থা
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি ও আয়
বেডবিবল ওয়েবসাইটের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, পর্ন ইন্ডাস্ট্রি থেকে বিশ্বব্যাপী বার্ষিক আয় প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা। এই বিপুল আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে। অর্থাৎ, ৮ লাখ কোটি টাকারও বেশি শুধু অনলাইন মাধ্যমের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
প্রযুক্তির ভূমিকা
স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা এবং ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসারের ফলে এই শিল্পে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। সাবস্ক্রিপশন মডেল, বিজ্ঞাপন, এবং পে-পার-ভিউ মডেলের মাধ্যমে অনলাইন পর্নোগ্রাফির আয় দিন দিন বাড়ছে।
ভৌগোলিক প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়ার দেশগুলো পর্ন ইন্ডাস্ট্রির প্রধান বাজার। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এই শিল্পে সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস হিসেবে চিহ্নিত।
সমাজে পর্ন ইন্ডাস্ট্রির প্রভাব
নৈতিক অবক্ষয়
বিশ্বজুড়ে পর্নোগ্রাফির প্রসার সমাজে নৈতিক অবক্ষয় তৈরি করছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এটি সহজলভ্য হওয়ার কারণে সম্পর্কের প্রতি দায়িত্বশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা কমে যাচ্ছে।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা
পর্নোগ্রাফির অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এটি এক ধরনের আসক্তি তৈরি করে, যা হতাশা, একাকীত্ব এবং আত্মবিশ্বাসহীনতার কারণ হতে পারে।
নারীর প্রতি অবমাননা
অনেক সময় পর্ন ইন্ডাস্ট্রি নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে। নারীর শরীরকে শুধু একটি ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখানো হয়, যা নারীর মর্যাদাকে অবমাননা করে এবং বাস্তব জীবনে নারী নির্যাতনের হার বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
ধর্ম এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামের দৃষ্টিতে পর্নোগ্রাফি
ইসলাম এমন যে কোনো কার্যকলাপকে নিষিদ্ধ করেছে, যা মানুষকে নৈতিকভাবে দুর্বল করে এবং সমাজে ফিতনা সৃষ্টি করে। পর্নোগ্রাফি মুসলিম সমাজে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ কারণ এটি পরিবার এবং সমাজের ভিত্তিকে নষ্ট করে দেয়। তবে, আধুনিক সমাজে ইসলামিক মূল্যবোধকে পিছিয়ে দেওয়া হয় এবং পর্নোগ্রাফির প্রসারকে ‘সভ্যতা’ হিসেবে প্রচার করা হয়।
মধ্যযুগীয় ধারণা নাকি আধুনিক চিন্তা?
অনেক শিক্ষার্থী ও তরুণ মনে করেন, ধর্মীয় শিক্ষা ‘মধ্যযুগীয় চিন্তা’। অথচ, প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় নৈতিকতা আমাদের সমাজের সুস্থ ভিত্তি গড়ে তোলে। যারা পর্নোগ্রাফিকে সভ্যতার অংশ মনে করেন, তারা ভুলে যান যে এটি মানবজাতিকে মানসিক ও সামাজিকভাবে পঙ্গু করছে।
বাল্য বিবাহ বনাম বাল্য প্রেম
বাল্য বিবাহ বন্ধের পক্ষে কাজ করা এনজিওগুলো সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও তারা “বাল্য প্রেম” নিয়ে প্রায় নীরব। বাস্তবতা হলো, বাল্য প্রেম থেকেও একই ধরনের শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয় এবং অনেক সময় অবৈধ গর্ভধারণের কারণে নবজাতকদের ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেওয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। অথচ এসব বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে যথেষ্ট উদ্যোগ দেখা যায় না।
মিডিয়ার ভূমিকা এবং দৃষ্টিভঙ্গি
অনেক মিডিয়া পর্ন ইন্ডাস্ট্রি এবং অশ্লীলতার প্রসারকে “ব্যক্তিগত স্বাধীনতা” হিসেবে প্রচার করে। একইসাথে “সাহসী নারী” হিসেবে এমন অনেক কর্মকাণ্ডকে প্রচার করা হয়, যা সমাজে অশ্লীলতাকে স্বাভাবিক করে তোলে। কিন্তু গার্মেন্টসে অবহেলিত নারী, ধর্ষণের শিকার নারী কিংবা গরিব নারীদের পক্ষে যথাযথ প্রতিবাদ কিংবা সহায়তা তারা করে না।
উপসংহার
পর্ন ইন্ডাস্ট্রি শুধুমাত্র একটি লাভজনক শিল্প নয়, এটি সমাজের নৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোকে ধ্বংস করার একটি বড় হাতিয়ার। এই শিল্পের অর্থনৈতিক শক্তি যত বড়ই হোক না কেন, এর নেতিবাচক প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে ধর্মীয় শিক্ষা এবং পারিবারিক দায়িত্বশীলতার প্রচার প্রয়োজন। পর্নোগ্রাফির মতো বিতর্কিত বিষয়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে এবং তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে সামাজিক, ধর্মীয় এবং শিক্ষাগত প্রতিষ্ঠানগুলোর একযোগে কাজ করা জরুরি।
“সভ্যতা হলো মূল্যবোধের সমষ্টি, যা মানুষের চরিত্র গঠন করে। অশ্লীলতা সেই সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেয়।”