দ্রব্যমূল্য বাড়ানো ও বাজার নিয়ন্ত্রণের শাস্তি: কুরআন, হাদীস এবং ইসলামের শিক্ষা

ইসলামে যেকোনো ধরনের জুলুম বা অন্যায় নিষিদ্ধ। দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে মানুষের কষ্ট সৃষ্টি করা একটি গুরুতর অপরাধ এবং এটি সরাসরি জুলুমের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করার ঘটনা দেখা যাচ্ছে, যা ইসলামী বিধানের দৃষ্টিতে স্পষ্টভাবে হারাম। কুরআন ও হাদীসের আলোকে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর এই প্রবণতার পরিণাম এবং ইসলামি ইতিহাসের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে এটি কতটা অন্যায়।

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনে জুলুম থেকে বিরত থাকার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। দাম বাড়িয়ে মানুষকে কষ্ট দেওয়া অন্যায় এবং জুলুমের একটি রূপ। আল্লাহ্‌ বলেন:

“আর তোমরা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ গ্রাস করো না।”

(সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৮)

“যারা অন্যায়ভাবে মানুষকে ঠকায় এবং পণ্য মজুত করে রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।”

(সূরা হুদ, আয়াত: ৮৫)

এই আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায় যে, দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে মানুষের জীবনযাপনকে কঠিন করে তোলা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় নয়। কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধি করা, মানুষের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং তাদের কষ্টে ফেলা একটি মারাত্মক অপরাধ।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিভিন্ন হাদীসে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো, খাদ্য মজুত করা এবং সিন্ডিকেট তৈরি করে মানুষের কষ্ট বাড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেন:

“যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য মজুত করে মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়, সে অন্যায়কারী হিসেবে গণ্য হবে।”

(সহীহ মুসলিম: ১৬০৫)

অন্য একটি হাদীসে এসেছে:

“মুসলমানদের উপর যে ব্যক্তি খাদ্য দ্রব্যের দাম বাড়াতে চায়, আল্লাহ তা’আলা তাকে আগুনে জ্বলতে দিবেন।”

(ইবনে মাজাহ: ২১৫৩)

এই হাদীসগুলোতে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে যে, বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং মানুষকে কৃত্রিম সংকটের মধ্যে ফেলা মারাত্মক গুনাহ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এটি শুধু মানুষের প্রতি জুলুম নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশনারও অমান্যতা।

vccbd

ইসলামের ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই যে, মুসলিম খলিফারা সবসময় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং জনসাধারণের কল্যাণের প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন।

হযরত ওমর (রাঃ) যখন খলিফা ছিলেন, তখন বাজার ব্যবস্থার উপর তার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল। তিনি কখনোই কাউকে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে মুনাফা করতে দিতেন না। হযরত ওমর (রাঃ) একবার বাজারে এক ব্যবসায়ীকে অতিরিক্ত মুনাফা করতে দেখে তার ব্যবসা নিষিদ্ধ করে দেন। তিনি বলেছিলেন, “যে ব্যক্তি অতিরিক্ত মুনাফা করতে চায়, সে যেন আমাদের বাজারে না আসে।” এভাবে তিনি সবসময় বাজারের সঠিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেন যাতে সাধারণ মানুষ কোনো কষ্ট ভোগ না করে।

ওসমানী খিলাফতের শাসনামলে বাজারে দ্রব্যের মজুত করা এবং সিন্ডিকেট তৈরি করার কোনো সুযোগ ছিল না। খিলাফতের পক্ষ থেকে বিশেষ নজরদারি এবং দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের মাধ্যমে সব সময় বাজারের ওপর নজর রাখা হতো, যাতে কোনো সিন্ডিকেট গড়ে উঠতে না পারে এবং সাধারণ মানুষ ন্যায্য মূল্য পায়।

কৃত্রিমভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে মুনাফা অর্জন করা ইসলামে স্পষ্ট হারাম হিসেবে বিবেচিত। অতিরিক্ত মুনাফা বা অবৈধ উপার্জন সম্পর্কে ইসলামে সতর্কতা রয়েছে। কুরআনে আল্লাহ বলেন:

“আর তোমরা মাপে কম দাও না এবং কম ওজন দিও না।”

(সূরা আর-রহমান, আয়াত: ৯)

ইসলাম এমন একটি ধর্ম, যা মানুষের জীবনকে সহজ ও কল্যাণময় করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো এবং মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলা ইসলামে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামি শিক্ষা অনুযায়ী, যেকোনো ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ডে ন্যায্যতা ও সততা রক্ষা করা আবশ্যক।

তাই, সিন্ডিকেট এবং মজুতদারি করে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করা একদিকে চোর ডাকাতির মতো অপরাধ, অন্যদিকে এটি স্পষ্ট হারাম এবং শাস্তিযোগ্য কাজ। একজন সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে ইসলামের অনুসরণ ও আল্লাহর বিধান মানা আমাদের জন্য সবচেয়ে উত্তম পথ।