সিদরাতুল মুনতাহা একটি বিশেষ স্থান, যা আসমানের সপ্তম স্তরের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। এটি মেরাজের রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সফরে উল্লেখিত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সিদরাতুল মুনতাহা সম্পর্কে কুরআন এবং হাদিসে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে, যা গভীর তাৎপর্য বহন করে।
১. কুরআনে সিদরাতুল মুনতাহার উল্লেখ
আয়াত:
“আর অবশ্যই তিনি তাঁকে (জিবরাইলকে) দ্বিতীয়বার দেখেছেন সিদরাতুল মুনতাহার কাছে। এর কাছেই রয়েছে জান্নাতুল মাওয়া। যখন সিদরার ওপর যা যা ঢেকে দেয় তা ঢেকে দিচ্ছিল। তখন তাঁর চক্ষু সরেনি এবং সীমালঙ্ঘন করেনি। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ দেখেছেন।”
(সূরা আন-নাজম: ১৩-১৮)
ব্যাখ্যা:
- “সিদরাতুল মুনতাহা”:
এটি একটি বিশেষ বৃক্ষ, যা সপ্তম আসমানের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। এটি এমন একটি সীমা, যা ফেরেশতাদের জ্ঞান এবং তাদের দায়িত্ব পালনের চূড়ান্ত সীমা। এর বাইরে কেবলমাত্র আল্লাহর অনুমতি দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সা.) পৌঁছেছিলেন। - “জান্নাতুল মাওয়া”:
সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে জান্নাতুল মাওয়া অবস্থিত, যা ঈমানদারদের স্থায়ী আবাস।
২. হাদিসে সিদরাতুল মুনতাহার বর্ণনা
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বর্ণনা:
মেরাজের রাতে সিদরাতুল মুনতাহার কাছে পৌঁছানোর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“তার (সিদরাতুল মুনতাহা) ফল ছিল বড় বড় পানির কলসির মতো এবং তার পাতা ছিল হাতির কান সদৃশ। যখন এটি আল্লাহর নূরের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়, তখন তার সৌন্দর্য বর্ণনা করা যায় না।”
(সহিহ বুখারি: ৩২০৭, সহিহ মুসলিম: ১৬২)
সিদরাতুল মুনতাহার বিশেষত্ব:
- এটি আসমান ও পৃথিবীর মধ্যে সমস্ত সৃষ্টির সীমা। এর বাইরে ফেরেশতা এবং অন্য কোনো সৃষ্টি যেতে পারে না।
- রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য মেরাজের রাতে এই সীমা অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছিল।

৩. “সিদরাতুল মুনতাহা” নামের অর্থ
- সিদরা:
এটি “বেরি গাছ” (লোট গাছ) বোঝায়। - মুনতাহা:
এর অর্থ হলো “শেষ সীমা”। এটি এমন একটি স্থান, যেখানে সৃষ্টি জগতের জ্ঞান ও ক্ষমতার সীমা শেষ হয়।
৪. সিদরাতুল মুনতাহার গুরুত্ব
(ক) ফেরেশতাদের সীমা:
সিদরাতুল মুনতাহা হলো এমন একটি স্থান, যা ফেরেশতাদের কাজের শেষ সীমা। এর বাইরে তারা যেতে পারে না।
(খ) নবীদের মর্যাদা:
রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন একমাত্র সৃষ্ট জীব, যিনি সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছেছিলেন।
(গ) আল্লাহর নিদর্শন:
এটি এমন একটি স্থান, যেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর অসীম নিদর্শন দেখেছিলেন, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
৫. সিদরাতুল মুনতাহার বর্ণনার বিশেষ দিক
সৌন্দর্য ও রহস্যময়তা:
- হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, সিদরাতুল মুনতাহার সৌন্দর্য এমন যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
- এটি আল্লাহর নূরে আচ্ছাদিত থাকে।
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা:
রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই এর কাছে পৌঁছেছিলেন এবং এটি দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন।
৬. সিদরাতুল মুনতাহা এবং মেরাজের শিক্ষা
(ক) আধ্যাত্মিক উচ্চতা:
সিদরাতুল মুনতাহার ঘটনা প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আধ্যাত্মিকভাবে সর্বোচ্চ অবস্থানে অধিষ্ঠিত।
(খ) আল্লাহর কুদরত:
এটি আল্লাহর কুদরতের একটি বিশেষ নিদর্শন, যা মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান এবং সৃষ্টিজগতের সীমারেখা বোঝায়।
(গ) ঈমান বৃদ্ধি:
মেরাজের ঘটনা এবং সিদরাতুল মুনতাহার বর্ণনা মুমিনদের মধ্যে ঈমান দৃঢ় করে।
৭. সিদরাতুল মুনতাহা সম্পর্কে অন্যান্য মতামত
তাফসির ইবনে কাসির:
ইবনে কাসির ব্যাখ্যা করেন যে, সিদরাতুল মুনতাহা এমন একটি স্থান যেখানে সমস্ত আদেশ অবতীর্ণ হয় এবং ফেরেশতারা তাদের দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা পান।
তাফসির কুরতুবি:
কুরতুবি ব্যাখ্যা করেছেন, এটি সৃষ্টিজগতের শেষ সীমা, যা আল্লাহর মহান নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি।
উপসংহার
সিদরাতুল মুনতাহা আসমানের সপ্তম স্তরের একটি সীমান্তস্থান, যা ফেরেশতাদের জন্য শেষ এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য বিশেষভাবে উন্মুক্ত করা হয়েছিল। এটি আল্লাহর কুদরত, তাঁর নৈকট্য, এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদার একটি অনন্য নিদর্শন। সিদরাতুল মুনতাহা আমাদের শিক্ষা দেয়, আল্লাহর প্রতি ঈমান, তাঁর কুদরত বোঝা, এবং আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার গুরুত্ব।
আল্লাহ আমাদের ঈমান আরও দৃঢ় করুন এবং তাঁর নিদর্শনগুলো বুঝার তাওফিক দিন। আমিন।